মোটিভেশনাল ছোট গল্প
বারান্দার সামনে বসে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলো শিশির। চলছে ভাদ্র মাস, কারেন্ট নেই, প্রচন্ড গরম। বিদ্যুতের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। শিশির দেখেছে যতই গরম বেশি পড়ে কারেন্ট ডিস্টার্ব ততই বেশি বেড়ে যায়। একেতো গ্রাম, তারপর পল্লী বিদ্যুৎ,সমস্যা তো যাবেই বেড়ে। ছোটবেলা থেকেই নিজের জন্মস্থানে থাকতে পারেনি শিশির।
বাবার চাকরির সুবাদে নানান জায়গায় থাকতে হয়েছে। ছোটবেলা থাকতে গ্রামটা খুব মিস করত সে। শুধুমাত্র ঈদের সময় গ্রামে আসার সুযোগ হত।এই গ্রামের ছেলেদের মত পুকুরে ঝাঁপ দেয়া ,গাছে চড়া ইত্যাদি পারেনা সে। আর এমনিতে নরম টাইপের ছেলে শিশির। স্কুলে থাকতে একবার দৌড় প্রতিযোগিতা দিয়েছিল সে ? হাস্যকরভাবে সবার শেষে হয়েছিল।
সেই থেকে আর কোন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেনি । এক ধরনের জড়তা,সংকোচ পেয়ে বসেছিল। বন্ধুরা যখন পুরস্কার হাতে নিত নিজেকে এত ছোট মনে হত যে বলার বাইরে।
মা বাবার তিরস্কার নিত্য সাথী ছিল। মাঝে- মধ্যে অসহ্য লাগত, মরে যেতে ইচ্ছে করত। অসহায় ভাবটা বেশি বোধ করলে কান্না চলে আসত।এই একটা বিষয় ভাল পারতো শিশির, অনেকটা ছিচকাদুুনে স্বভাবের ছিল সে। পড়াশোনায় তেমন খারাপ ছিল না। ক্রমিক নং ১-৫ এর ভিতর থাকত।
মনে পড়ে একটি ঘটনা তার। সেবার অষ্টম শ্রেণির পরীক্ষায় বরাবরের মতো পঞ্চম স্হান অধিকার করেছিল সে। অথচ প্রথম সাময়িক ও দ্বিতীয় সাময়িক এ পেয়েছে দ্বিতীয় স্থান। খটকা লাগছিলো ব্যাপারটা। কান্না করতে করতে বাড়িতে ফিরে আসা। বড় ভাই জিজ্ঞেস করে জেনে নিল ব্যাপারটা। তৎক্ষনাৎ আবার স্কুলে গিয়ে অভিযোগ দাখিল করা।
তদন্তে সত্য বেরিয়ে এসেছিল। খুশির চেয়ে রাগ বেশি হয়েছিল শিশির। বার্ষিক পরীক্ষায় এত বড় একটা গলদ কেমন করে সম্ভব? ইচ্ছাকৃত বলে মনে হচ্ছিল। আবার ফলাফল ঘোষণা করা হল। পঞ্চম স্হান দ্বিতীয় স্হানে আসাটা অনেকে ভালো চোখে দেখল না। গুজব রটে গেল ঘুষ খাওয়ানো হয়েছে শিক্ষকদের।
কে কাকে ঘুষ দিয়েছে এটা আগেই বুঝা গিয়েছে। আব্বুকে বলায়,অনেক সমালোচনা করলেন শিকক সমাজের। তারা যদি দুর্নীতিবাজ হয় তবে দেশটার কি হবে। আরেকটি বিষয়ও মাথায় এসেছে শিশিরের। সে কি প্রথম থেকে এই পর্যন্ত শুধু ৫ নম্বরই হয়েছে?
যাই হোক আল্লাহই করবে বিচার। কিন্তু ঐদিনের পর থেকে শিক্ষকদের প্রতি আস্তা উঠে গিয়েছিল। যত সব চোরের দল। তবে এস.এস.সি পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিল শিশির।
জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময় এসেছিল তখন। ভুলতে পারবেনা সে। তবে এর পরের পদক্ষেপের জন্য আফসোস করতে হয় এখনো। হয়তো করতে হবে সারাজীবন।
গ্রামের পরিবেশে লেখাপড়া করে যে ভুলটা করা হয়েছে সেটার মাশুল দিতে হচ্ছে আজ। দোষটা তার একার নয়। গুরুত্বটা যদি পরিবার বুজতো তাহলে আজ কি এই দশা হতো ?
গ্রামের পরিবেশে এসে নিজের আমিত্ব বজায় রাখতে পারেনি শিশির। বাজে ছেলেদের সাথে মিশতে শুরু করল। লাটে উঠল পড়াশুনা। বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়কে ভালভাবে পড়ানোর মতো হয়ে উঠেনি কলেজটা।
বলা হয়নি, শিশিরের বাবা অবসর নেওয়াতে গ্রামে চলে আসতে হয়েছিল ওদের। একটা মেয়ের খপ্পরে পরে আরো বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল সে। সমস্ত অনিয়ম ও উদাসীনতার ফল জন্ম দিল পরীক্ষায় খারাপ করার।
প্রথমবারের মতো জীবনে ধাক্কাটা খেল শিশির। তখনও শিক্ষা হয়নি তার। এর পরের বার অবশ্য টেনে-টুনে পাশ করল। এরপর স্নাতক পর্ব। কয়েকজন পরামর্শ দিয়েছিল য়ুনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার। পাত্তা পায়নি ওরা।
একটা ফার্মেসি দিয়েছিল শিশির। সেখানেও ভুল ডিসিশন। ভালো কোন জংশনে না হওয়ায় ব্যবসা হয়নি। চার-পাঁচ বছর করার পরই তল্পি-তোলপা গোছানো।
ভাবতে ভাবতে কখন বিদ্যুৎ চলে আসলো টের পায়নি। মায়ের কর্কশ ডাকে সম্বিৎ ফিরল তার। রাত নয়টা বেজে গেছে। আব্বুর ডিনারের সময় হয়ে আসলো। শিশিরকে যেতে হবে রান্নাঘরে। পরিবেশন করার দায়িত্ব তার।
এন.জি.ও -তে ছোট একটা চাকরি করে সে। মাসিক যা পায় কোনো মোতে চলে যায়। জমা করার কোনো সুযোগ নেই। বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে তার। সমবয়সীরা অনেক আগে ফরজ কাজ সেরে ফেলেছে।
কেউ কেউ আবার ছেলে নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটিও করে। তিক্ত মনটা আরো বিষিয়ে যায় এসব দেখে। মা-বাবাকে ইঙ্গিতে বলেছে কয়েকবার। না শোনার ভ্যান করেছে তারা।
অবশ্য তাদের দোষ নেই এক্ষেত্রেও। বিয়ের খরচটা অন্তত জোগাড় করতে হবে শিশিরকে।
অনেক ঘটনা জানে শিশির। তার এক বন্ধু বেকার ছিল। পড়াশুনায় ভয়ঙ্কর এক গাধা। দেখতেও যাচ্ছেতাই। কিন্তু কান্ডটা দেখো,দারুন এক রূপসীকে কিভাবে যেন পটিয়ে ফেলল গাধাটা। মেয়েটার বাবা ব্যবসায়ী,বিস্তর টাকার মালিক।
বাবা বিয়েতে অমত থাকায় পালিয়ে গেল মেয়েটি,চুপিসারে কোর্ট-মেরেজ করে ফেলল। সঙ্গে অনেক টাকা নিতে ভুল করেনি। বিয়ের সাক্ষী হতে হয়েছে শিশিরকে। প্রায় সাতটা দিন ভাল করে ঘুমাতে পারেনি শিশির।
আফসোস করেছে শুধু,তার কপালে কেন এরকম আসেনা।
0 মন্তব্যসমূহ